সম্প্রতি জিএসসি অ্যাডভান্সড রিসার্চ অ্যান্ড রিভিউয়ে প্রকাশিত এক গবেষণায় ঢাকার বায়ুদূষণের উদ্বেগজনক পরিস্থিতির বর্ণনা উঠে এসেছে। এটি জনস্বাস্থ্য ও ঢাকা শহরের অর্থনীতির জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গবেষণাটি পরিচালনা করেছেন আশফাকুর রহমানসহ ইয়ং'স অর্গানাইজেশন অব আরবান রিসার্চ (ইউওআর), ওয়েস্টার্ন ইলিনয় ইউনিভার্সিটি এবং আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের একদল গবেষক। এই গবেষণায় শহরের বায়ুর মানের ওপর দ্রুত নগরায়ন, দুর্বল অবকাঠামো এবং নিয়ন্ত্রণহীন যানবাহনের ধোঁয়ার ক্ষতিকর প্রভাব তুলে ধরা হয়েছে।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত পরিচালিত এই গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, ঢাকায় বস্তুকণার (পিএম২.৫) ঘনত্ব জাতীয় নিরাপত্তা নির্দেশিকার তুলনায় ক্রমাগত বেশি থাকে। বিশেষত শীতকালে এর মাত্রা পড়ে প্রতি ঘন মিটার বাতাসে ১৬৫-১৭৫ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত পৌঁছায়। এটি অনুমোদিত সীমার চেয়ে উল্লেখযোগ্য হারে বেশি।
অন্যদিকে বর্ষাকালে বস্তুকণার ঘনত্ব কিছুটা কম থাকে। এ সময় গড়ে প্রতি ঘন মিটার বাতাসে এর পরিমাণ ৩০-৩৫ মাইক্রোগ্রাম থাকে। বস্তুকণার এই মাত্রা শ্বাসযন্ত্রের স্বাস্থ্য-বিশেষ করে দুর্বল জনগোষ্ঠীর জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
ঢাকার দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি (২১ মিলিয়নের বেশি) দীর্ঘমেয়াদি ট্রাফিক জ্যাম এবং শিল্প কারখানার ধোঁয়ার সৃষ্টি করেছে, ফলে শহরের বায়ু মান আরও খারাপ হয়েছে।
গবেষণায় তুলে ধরা হয়েছে, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং শিল্প দূষণকারীরা কার্বন ডাই অক্সাইড (সিও২), নাইট্রোজেন অক্সাইড (এনওএক্স), সালফার অক্সাইড (এসওএক্স) এবং ক্লোরোফ্লোরোকার্বনের (সিএফসি) মতো ক্ষতিকারক রাসায়নিকগুলো নির্গত করে। এটি স্থানীয় বায়ু দূষণ এবং বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন- উভয় ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে।
ওয়েস্টার্ন ইলিনয় ইউনিভার্সিটির আশফাকুর রহমান বলেন, ‘আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার বায়ুর মানের অবনতি মোকাবিলায় তাৎক্ষণিক ও সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। এটি কেবল পরিবেশগত সমস্যা নয়-এটি জনস্বাস্থ্য ও টেকসই অর্থনীতির বিষয়।’
কঠোর নির্গমন মান, উন্নত নগর পরিকল্পনা এবং পরিচ্ছন্ন পরিবহন বিকল্পগুলোর প্রচারের উপর জোর দিয়েছেন গবেষকেরা। ঢাকার নগর কাঠামোয় সবুজ স্থান এবং পায়ে হাঁটার জন্য উপযোগী অঞ্চলগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করাও উপকারী হবে।
জনসচেতনতা প্রচারাভিযানের ওপর আরও জোর দেওয়া এবং বায়ু মানের বিধিমালা প্রয়োগ স্থায়ী নগরায়নে সহায়তা করতে পারে। এটি ঢাকার নাগরিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায়ও সাহায্য করবে।
বিশ্বব্যাংকের মতে, শুধু ২০১৯ সালেই বায়ুদূষণের কারণে ক্ষতির পরিমাণ ১১.৫ বিলিয়ন ডলার থেকে ১৩ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশের জিডিপির ৩.৯ শতাংশ থেকে ৪.৪ শতাংশের সমান। টেকসই উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেয়-এমন নীতিগুলোর বাস্তবায়ন দ্রুততর করতে বাংলাদেশ সরকারকে আহ্বান জানানো হয়েছে এই গবেষণায়; বিশেষ করে ঢাকার মতো নগর এলাকায় যেখানে জীবনমানের দ্রুত অবনতি হচ্ছে।
চীনের জিয়াংসি নরমাল ইউনিভার্সিটির কলেজ অব কম্পিউটার অ্যান্ড ইনফরমেশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সহগবেষক ফয়সাল আহমেদ বলেন, ‘ঢাকায় বায়ু দূষণ মোকাবিলায় সরকার, বেসরকারি খাত ও নাগরিক সমাজসহ সব স্টেকহোল্ডারদের জড়িত বহুখাতভিত্তিক পদ্ধতি প্রয়োজন। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পরিচ্ছন্ন বায়ু নিশ্চিত করা সম্মিলিত দায়িত্ব।’
আরও পড়ুন: বৃষ্টিস্নাত দিনেও ঢাকার বাতাস সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর
গবেষণায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি, বাংলাদেশের প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ এবং চীনের চেংদু নিউসফট বিশ্ববিদ্যালয়ের সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগসহ বিভিন্ন একাডেমিক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞরা এই গবেষণার সঙ্গে সম্পৃক্ত।
জিএসসি অ্যাডভান্সড রিসার্চ অ্যান্ড রিভিউসের পর্যালোচনার পর গৃহীত বিস্তৃত গবেষণার মাধ্যমে এই জটিল সমস্যা মোকাবিলায় তাৎক্ষণিক এবং দৃঢ় পদক্ষেপের আহ্বান জানানো হয়েছে।
অতীতে কার্বন নিঃসরণ কমানোর কিছু প্রচেষ্টা থাকলেও গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকাবাসীর টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে আরও অনেক কিছু করা দরকার। কঠোর বায়ু মানের বিধিমালা বাস্তবায়ন এবং দায়িত্বশীল নগরায়ণ অনুশীলনের প্রচার এই লক্ষ্য অর্জনের দিকে প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে।
সায়েন্স অ্যাডভান্সে প্রকাশিত আরেকটি গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০০৫ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ঢাকায় বায়ুদূষণের কারণে ২৪ হাজার মানুষের অকাল মৃত্যু হয়েছে। এটি ৪৬টি শহরের মধ্যে সর্বোচ্চ। সায়েন্স অ্যাডভান্সেস একটি পিয়ার-রিভিউড, বহুমুখী, উন্মুক্ত প্রবেশাধিকার বৈজ্ঞানিক জার্নাল; যা ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এবং আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অব সায়েন্সে (এএস) প্রকাশিত।